হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর :


দাওয়াত ও তাবলিগ ইসলামের প্রাণশক্তি। বিশ্বজুড়ে ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নতকরণে দাওয়াত ও তাবলিগের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর মনোনীত শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা ইসলামের যাবতীয় অনুশাসন যথার্থ মেনে চলার মধ্যেই উভয় জগতের শান্তি, সফলতা ও মুক্তি নিহিত। এই বোধ-অনুভূতি মানবমনে জাগ্রত করতে যুগে যুগে আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত নবী-রাসূলগণ দাওয়াতে দ্বীনের এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। তথাপি দাওয়াতের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার সুস্পষ্ট নির্দেশ-নির্দেশনাও এসেছে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিৎ যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহবান করবে, আর সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দান করবে। তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা- আলে ইমরান, আয়াত- ১০৪)। এভাবে দ্বীনের পথে দাওয়াত দানকারীদের অনুপ্রাণিত করে আলাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘সে ব্যক্তির চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আলাহর পথে দাওয়াত দেয় এবং নিজেও সৎকাজ করে, আর বলে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা- হা-মীম সিজদাহ্, আয়াত- ৩৩)
বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী (স.) বলেন, ‘তোমরা একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও।’ (তিরমিযী)। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এই পবিত্র বাণীর মাধ্যমে পুরো উম্মতের ওপর দাওয়াতে দ্বীনের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। রাসূল (স.) এর এই আহবানে সাড়া দিয়ে অগণিত সাহাবায়ে কেরাম (র.) ইসলামের চিরন্তন পয়গাম নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহ পাকের মুখ্লিস বান্দাহগণের নিরলস প্রচেষ্টায় বিভিন্ন উপায় ও পদ্ধতিতে আজো দ্বীনি দাওয়াতের পবিত্র খেদমত অব্যাহত রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এই দাওয়াতী ধারায় যেসব উপায় ও পদ্ধতি কার্যকর তৎমধ্যে হক্কানী ওলামায়ে কেরামের ওয়াজ-নসীহত, বুযুর্গানে দ্বীন কর্তৃক আত্মশুদ্ধির খেদমত, দ্বীনি মাদ্রাসায় তা’লীম-তারবিয়্যাত, তাবলিগী মেহনত, স্বচ্ছধারার ইসলামী রাজনৈতিক তৎপরতা, ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখকদের লিখনী অন্যতম। দাওয়াতের এসব অবলম্বনের মধ্যে তাবলিগী মেহনতই সবচেয়ে জনমুখী ও বিশ্ব সমাদৃত।
মহান আল্লাহর হুকুম ও রাসূল (স.) এর সুন্নাতের যথার্থ অনুসরণে তাবলিগী মেহনতে আত্মনিবেদিত ভাইয়েরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দ্বীনি দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। বিশ্বনন্দিত আলেমেদ্বীন আলামা ইলিয়াস (রহ.) বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মাঝে ঈমানের দাওয়াত পৌঁছানোর মহান প্রয়াসে তাবলিগী মেহনতের এই পদ্ধতি চালু করেন।
প্রতিটি মানুষ কিভাবে সাচ্ছা ঈমানদার হতে পারে সেই লক্ষ্যেই বিশ্বব্যাপী চলছে দাওয়াত ও তাবলিগের বিরামহীন প্রয়াস। সবধরণের পার্থিব লোভ-লালসা ত্যাগ করে আল্লাহর দেওয়া মাল-সম্পদ, শক্তি, সময় আল্লাহর পথে কুরবানী দিয়ে তাবলিগের সাথীগণ যে নিরবচ্ছিন্নভাবে দাওয়াতের জিম্মাদারী পালন করে চলেছেন তা সত্যিই নজিরবিহীন ও প্রশংসনীয়।
নৈতিক অবক্ষয়ের এই যুগে যখন বিভিন্ন ইসলামী মাহফিলের কতিপয় বক্তাগণ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট আর্থিক বিনিময়ের নিশ্চয়তা নিয়ে এবং নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দিয়ে দাওয়াত গ্রহণের দুঃখজনক প্রবণতা শুরু হয়েছে। উম্মাহর এমন ক্রান্তিকালে কোন ধরনের পার্থিব বিনিময় ছাড়া মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে গিয়ে, মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে অত্যন্ত কোমল ও নম্র ভাষায় আল্লাহভোলা মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার লক্ষ্যে তাবলিগের আত্মত্যাগী ভাইয়েরা ইখলাসপূর্ণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দ্বীনের যে দ্বীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তা মহান আল্লাহ তা’আলার বিশাল নিয়ামত।
ইসলামের সঠিক রূপরেখা সবক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মাধ্যমে উভয় জগতের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের ব্রত নিয়ে তাবলিগী মেহনতে শামিল মুবালিগ ভাইগণ বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছেন। ফলশ্রুতিতে পবিত্র এই দাওয়াতী মেহনতের অবদানে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে ইসলামের সৌরভ-সৌন্দর্য। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সমবেত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। এভাবে বিশ্বব্যাপী ইসলামের পুনর্জাগরণে দাওয়াত ও তাবলিগের ভূমিকা অনন্য ও অনস্বীকার্য।
প্রতি বছর আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয় তাবলিগী বিশ্ব ইজতেমা। সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মু’মিন-মুসলমান এই ইজতেমায় সমবেত হন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমবেত মু’মিন-মুসলমানেরা ঈমান-আমলের মৌলিক অনুশীলনে নিবিষ্ট হন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও কক্সবাজার সমূদ্র তীরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জেলা ইজতেমা। জেলার প্রত্যন্ত জনপদের তৌহিদী জনতা এই পবিত্র ইজতেমায় শরীক হয়ে ঈমানী চেতনা ও আমলী স্পৃহাকে শাণিত করার নিষ্ঠাপূর্ণ মেহনতে শামিল হন। বিশিষ্ট ওলামা-মশায়েখের ওয়ায-নসীহত ও অসংখ্য মু’মিন মুসলমানের যিকির -আযকারের পবিত্র ধ্বনিতে আল্লাহপ্রেমের ঢেউ তরাঙ্গায়িত হচ্ছে। ঈমানদার জনতার পদভারে মুখরিত আজ সাগর তীর। হক্কানী ওলামা-মশায়েখের সুষ্ঠু দিক-নির্দেশনায় দাওয়াত ও তাবলীগের ইখলাসপূর্ণ মেহনতের এ ধারাকে আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখুন। আমিন।